মসজিদ কমিটি: যোগ্যতা, গঠন ও দায়িত্ব
বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থায় মসজিদ পরিচালনা কমিটি মসজিদের গুরুত্বপূর্ণ অবিচ্ছেদ্য অংশ। মসজিদের যথাযথ ব্যবহার, মসজিদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা ও উন্নতি ইত্যাদি বহুলাংশে নির্ভর করে মসজিদ কমিটির যোগ্যতা ও সদিচ্ছার ওপর।
কিন্তু সঠিক জ্ঞানের চর্চা না থাকায় এবং নৈতিক অবক্ষয় বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক মসজিদের কমিটিতে বিভিন্ন ধরণের সমস্যা দেখা যায়।
মূল আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে একটি মূলনীতি বলে রাখা আবশ্যক।
ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে, মসজিদ কমিটির পদকে নেতৃত্ব মনে করা চরম বোকামী। মসজিদ কমিটির কোথাও জায়াগা হলে এটাকে নিছক খেদমত মনে করা দরকার।
এ খেদমত আল্লাহর ঘরের খেদমত। মুসল্লিদের খেদমত।
তাই দুনিয়ার কোনো চাওয়া-পাওয়া ব্যতিরেকে মুক্তমনে শুধু আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের ইচ্ছায় ইবাদত মনে করে খেদমতের মানসিকতা নিয়ে কমিটিতে অংশ নিতে হয়। সামাজিক পদমর্যাদা বৃদ্ধির অভিলাষে কমিটিতে যোগ দেওয়া হারাম।
কমিটি গঠন পদ্ধতি ও মেয়াদকাল
প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতিতে ক্ষেত্রবিশেষ অর্থের অপচয় হয়, দলাদলির সৃষ্টি হয়, কোন্দল বৃদ্ধি পায়, পরষ্পর শত্রুতার স্থায়ী বীজ বপন হয় ও মহল্লাবাসী বিভক্ত হয়ে যায়। তাই পরামর্শের ভিত্তিতে কমিটি গঠন যুক্তিযুক্ত। এক্ষেত্রে মহল্লার মুরুব্বি, নামাজি, পরহেজগার ও জ্ঞানীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন।
কমিটির মেয়াদ নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে আলেমদের অভিমত হলো, কাউকে কোনো দায়িত্ব দেয়ার পর তিনি যতদিন পর্যন্ত সুস্থতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারেন, দুর্নীতি ও চরিত্রহীনতার শিকার না হোন এবং স্বেচ্ছায় অব্যাহতি না নেন- ততদিন পর্যন্ত তাকে দায়িত্ব থেকে না সরানো ভালো। এতে করে কাজের ধারাবাহিকতা ঠিক থাকে।
কমিটির যোগ্যতা ও গুণাবলী
মসজিদ কমিটি অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ধর্মীয় দায়িত্ব। যে কারও হাতে এ দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া ঠিক না। তাই কাউকে মসজিদ কমিটির জন্য বাছাই করার আগে অবশ্যই নিশ্চিত হওয়া দরকার- মসজিদ কমিটির দায়িত্ব নেয়ার মতো যোগ্যতা তার আছে কি-না।
আল্লাহর রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যখন আমানত নষ্ট করা হবে তখন থেকে কিয়ামতের অপেক্ষা করতে থাকবে। জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) কীভাবে আমানত নষ্ট করা হবে? তিনি বললেন, যখন অযোগ্যকে দায়িত্ব দেয়া হবে তখন থেকে কিয়ামতের অপেক্ষা করতে থাক। -সহিহ বোখারি: ৬৪৯৬
মসজিদ কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার যোগ্যতা নয়টি। যথা-
১. মোতাওয়াল্লি বা কমিটির সভাপতি হবেন তারা-
ক. মসজিদের জমিদাতা, খ. তদীয় কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তি, গ. ইসলামি প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান, ঘ. তদীয় নিযুক্ত স্থানীয় প্রশাসক, ঙ. কোরআন-সুন্নাহমতে নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতি, চ. মহল্লাবাসী কর্তৃক মনোনীত প্রতিনিধি।
২. প্রাপ্ত বয়ষ্ক হওয়া।
৩. মানসিকভাবে সুস্থ হওয়া।
৪. ওয়াকফ, দান ইত্যাদি সংগ্রহ ও ব্যয় সম্পর্কে শরয়ী মাসআলার জ্ঞান থাকা।
৫. মসজিদ ব্যবস্থাপনার বৈষয়িক যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকা।
৬. আমানতদার হওয়া। অর্থ আত্মসাৎ ও তসরুফ তো দূরের কথা সাময়িক তসরুফেরও কোনো আশঙ্কা না থাকা।
৭. এমন কোনো কাজের অভ্যাস না থাকা- যেগুলো মানুষকে সর্বস্বান্ত করে। যেমন- জুয়াখেলা, মদপান করা ইত্যাদি।
৮. কোনো কবিরা গুণাহতে প্রকাশ্যে লিপ্ত না থাকা। অতএব, যারা নামাজ পড়ে না, নামাজের জামাতে শরিক হয় না, রোজা রাখে না, ফরজ হওয়া সত্ত্বেও হজ করে না, জাকাত দেয় না, সুদি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে, সুদ গ্রহণ করে এককথায় প্রকাশ্য পাপকাজে লিপ্ত কাউকে মসজিদ কমিটির জন্য মনোনীত করা নাজায়েয।
মসজিদ কমিটির কোনো সদস্যের ব্যাপারে কোনো কবিরা গুণাহতে জড়িত থাকার বিষয়টি সমাজে প্রকাশ পেয়ে গেলে তাকে বরখাস্ত করা ওয়াজিব। এমনকি, সে যদি জমিদাতা কিংবা ওয়াকফকারী কর্তৃক মনোনীতও হয় তবুও তাকে বরখাস্ত করতে হবে। -আদ দুররুল মুখতার, ওয়াকফ অধ্যায়
৯. মসজিদ কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার আগ্রহ ও চেষ্টা না থাকা।
আল্লাহর রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, আমরা কোনো পদপ্রার্থী বা পদপ্রত্যাশীকে পদ দেই না। -সহিহ বোখারি: ৭১৪৯
তিনি (সা.) আরও ইরশাদ করেছেন, তুমি পদপ্রার্থী হবে না। যদি প্রার্থী হয়ে পদ পাও তবে আল্লাহর পক্ষ থেকে তা তোমার ওপর নিক্ষেপ করা হবে। আর যদি প্রার্থী না হয়ে পদ পাও তবে আল্লাহর পক্ষ থেকে দায়িত্ব পালনে তোমাকে সাহায্য করা হবে। -সহিহ বোখারি: ৭১৪৭
নবী করিম (সা.) আরও বলেছেন, অতি শীঘ্রই তোমরা পদের প্রতি লোভী হবে। কিয়ামতের দিন তা লজ্জার কারণ হবে। -সহিহ বোখারি: ৭১৪৮
মসজিদ কমিটির দায়িত্ব
১. মসজিদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও উপার্জনের হেফাজত করা। শরিয়ত অনুমোদিত প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় করা। অপ্রয়োজনীয় ও শরিয়তে অনুমোদিত নয়- এমনসব খাতে সম্পদের ব্যয় না করা। ইদানিং দেখা যাচ্ছে, শরিয়ত অনুমোদনবিহীন খাতে মসজিদের সম্পদ ব্যয়ের প্রবণতা বেড়েছে। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
২. আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত হিসাব স্বচ্ছভাবে সংরক্ষণ করা।
৩. সাধ্যমতো সর্বাধিক উপযুক্ত ইমাম নিয়োগ দেয়া। এ ব্যাপারে বিজ্ঞ আলেমদের থেকে পরামর্শ নেয়া।
৪. যোগ্য মোয়াজ্জিন নিয়োগ দেয়া।
৫. প্রয়োজন অনুপাতে খাদেম নিয়োগ দেয়া।
৬. প্রয়োজন অনুসারে মসজিদের নির্মাণ, মেরামত ও সংরক্ষণ কাজ সম্পন্ন করা।
৭. অজু, ইস্তেঞ্জা, পানি, বাতি, পাখা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা। মসজিদ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে সচেষ্ট হওয়া।
৮. মসজিদ আবাদের উদ্যোগ নেয়া। মসজিদ আবাদের অর্থ হলো- নিয়মিত আজান ও জামাত হওয়া, শিশুদের জন্য মক্তব থাকা, বয়ষ্কদের জন্য কোরআন এবং শরিয়তের ফরজ পরিমাণ জ্ঞান শেখার ব্যবস্থা থাকা ও দাওয়াতের কাজ চালু থাকা।
কমিটির সকল সদস্যদের উচিৎ উল্লেখিত দায়িত্বসমূহ যথাযথভাবে পালনে যত্নবান হওয়া।
https://slotbet.online/